রাজশাহী: কৃষকের 'সোনার ডিম' খ্যাত আলু রোপণের ভরা মৌসুম চলছে। আকাশছোঁয়া দাম পাওয়ায় এবারে আলুচাষে ঝুঁকেছেন নতুন করে অনেকেই। প্রান্তিক কৃষকেরা এরইমধ্যে রোপনের কাজ প্রায় শেষ করেছেন। এবারে চলছে কৃষক কাম ব্যবসায়ীদের হাজার হাজার বিঘাতে আলু রোপনের কাজ। জেলার বিভিন্ন মাঠে যেদিকে চোখ যাচ্ছে শুধুই আলু রোপনের সাজ সাজ ব্যস্ততা।
অগ্রহায়ণের সোনালি ধানের গোলা ভরা ফসল এখন কৃষকের উঠোনে শোভা ছড়াচ্ছে এখনো। পাকা ধান ঘরে তোলার পর পরই তাই অনেকে আলুর জন্য জমি প্রস্তুত করেই আলুর বীজ রোপনে শীত উপেক্ষা করে সকাল থেকে সন্ধ্যা মাঠে কাজ করছেন কৃষকরা। জমি তৈরি করা, হিমাগার থেকে বীজ উত্তোলন, আগাছা পরিষ্কার, সার প্রয়োগ এবং প্রস্ততকৃত জমিতে আলু রোপণের কাজে এখন তারা মহাব্যস্ত।
রাজশাহীর ৯টি উপজেলার বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে কৃষকরা জমি চাষ, সার প্রয়োগ, আগাছা পরিষ্কার করছেন অনেক আগেই। আলু রোপনের এই শেষ সময়ে যারপরনাই ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। ডায়মন্ড, গ্রানুলা, এ্যাস্টেরিক ও কার্ডিনাল জাতের বীজ আলু রোপন করেছেন।
তবে চাহিদার তুলনায় সরকারিভাবে বরাদ্দ কম থাকায় টিএসপি সারের ঘাটতির আশংকা দেখা দিয়েছিল। অনেকে বেশিদামে এমনকি সরকার নির্ধারিত দামের প্রায় দ্বিগুন দামে টিএসপি করেছেন। এক্ষেত্রে বাজারে সার না থাকায় প্রান্তিক চাষিরাই হয়রানির শিকার হয়েছেন বেশি। এখন অবশ্যই স্বাভাবিক দামেই বিক্রি হচ্ছে টিএসপিসহ অন্যান্য রাসায়নিক সার। আলুর দাম পাওয়া থেকে শুরু করে সার পাওয়া পর্যন্ত আলু সুবিধায় থাকে ব্যবসায়ী কাম আলু চাষিরা।
আলু রাজশাহীর অর্থকরী ফসল। ধানের পরেই ব্যাপকভাবে আলুর আবাদ হয়ে থাকে। মৌসুমের শুরু থেকেই আলু দাম ভাল ছিল। এতে চাষিরাও খুশি হচ্ছেন। এবারে করোনা সংকট ও অতিবৃষ্টিকে পুঁজি করে আলু চাষি কাম ব্যবসায়ীরা অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেশি দামে আলু বিক্রি হচ্ছে। সরকারের হস্তক্ষেপেও দাম এখনো অনিয়ন্ত্রিত। এই অবস্থাতে আবারো আলু রোপনের মৌসুম শুরু হয়েছে। খুবই কম সময়ের মধ্যে জেলায় ব্যাপক জমিতে আলু চাষ হয়ে থাকে। এ জন্য দেখা দেয় হুড়াহুড়ি পাড়াপাড়ি। অনেকটা একই সঙ্গে রোপন করা হয় বলে গ্রামের চাষি পরিবারে দম ফেলার সময় থাকে না।
চাষিদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, গত দুই বছর থেকে দাম ভালো পাওয়ায় এখন আলু চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন তারা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবারো আলুর বাম্পার ফলন হওয়ার আশা করছেন তারা। কৃষি বিভাগ থেকে আলু চাষের প্রশিক্ষণ ও উৎপাদিত আলু সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ক্রয় করলে কৃষকরা বেশি লাভবান হওয়ার পাশাপাশি আলু চাষে আরও আগ্রহী হবেন বলেও জানিয়েছেন তারা।
রাজশাহীর পবা উপজেলার তেঘর গ্রামের প্রান্তিক আলু চাষি আফাজ উদ্দিন সরকার বলেন, এই বছর আড়াই বিঘা জমিতে আলুর চাষ করেছেন। বাজারে এখন আলুর দাম অনেক বেশি। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। শেষ পর্যন্ত কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না দেখা দিলে এবারও আলুর বাম্পার ফলন হবে।
একই উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের তেবাড়িয়া গ্রামের কৃষক মোস্তফা জামান বলেন, বাজারে এখনও আলুর দাম আকাশ ছোঁয়। বলা যায়- পেঁয়াজের সাথে পাল্লা দিয়ে আলুর দাম বাড়ছে। এ জন্য তিনি এবার আলু চাষের মনোযোগ দিয়েছেন। ফলন ভালো হলে অধিক মুনাফার মুখ দেখা যাবে। গতবার তিনি ১২ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। এ বছর দাম বেশি থাকায় ২০ বিঘা জমিতে আলুর চাষ শুরু করেছেন। তবে বীজের দাম বেশি থাকায় এবং শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় গতবারের চেয়ে এবার আলু চাষের খরচও বেড়েছে বলে জানান এ কৃষক।
জেলার মোহনপুর উপজেলার মৌগাছি ইউনিয়নের নুড়িয়াক্ষেত্র এলাকার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আলু চাষ করেন মোবারক হোসেন। প্রায় ১৫ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে আলুচাষ করছেন তিনি। এবারো ১৫০ বিঘা জমিতে আলুচাষ করছেন তিনি।
আলু চাষ করে বরাবরই বৃহস্পতির দেখা পেয়েছেন মৌগাছি গ্রামের নুরুল ইসলাম। তিনি প্রতিবছরই কয়েকশো বিঘা আলু চাষ করে থাকেন। এবারে তিনি ২৫০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করছেন। প্রতি বিঘা জমিতে খরচ হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, আলু উঠানো ও হিমাগারে রাখা পর্যন্ত প্রতিবিঘা জমিতে আলুতে খরচ হবে প্রায় ৬৫ হাজার টাকা।
এদিকে, রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এ বছরও রাজশাহী জেলায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আলুর আবাদ হলে তা দিয়ে রাজশাহী জেলার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা যাবে। তবে এবারে জেলাতে আলু চাষ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, উত্তরের এই জেলায় ডায়মন্ড, কার্ডিনাল ও এ্যাস্টেরিক জাতের আলু বেশি চাষ হয়। ২০১৯-২০ মৌসুমে রাজশাহী জেলায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়েছে। গড়ে হেক্টর প্রতি ২৬ টন করে আলু উৎপাদন হয়েছে।
মোট আলু উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৬৩ হাজার টন। আর আগের মৌসুমের গড় উৎপাদন হিসেবে চলতি বছরও এই জেলায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আলুর চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ডিডি) শামসুল হক বলেন, নির্ধারিত সময়ে আলু চাষের জন্য জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে উঠান বৈঠক ও নিয়মিত সমাবেশ হচ্ছে। এর মাধ্যমে আলু চাষিদের কৃষি পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় আলু চাষিরা যেন অধিক ফলন পান সেজন্য জমি প্রস্তুত, সেচ, সার ও বালাইনাশক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে একটি পূর্ণ ধারণা দেওয়া হয়েছে। তবে ২০২০-২১ মৌসুমে বাজারে আলুর ভালো দাম ভালো পাওয়ায় চাষিরা এবার আলু চাষে অধিক মনোযোগী হয়ে উঠেছেন।
জমির চাষবাস নিয়ে নিয়মিতভাবে উপজেলা ও থানা কৃষি কর্মকর্তা এবং ব্লক সুপারভাইজারদের সাথে পরামর্শ করছেন। আবহাওয়া অনুকূলে আছে এবারও আলুর আশানুরূপ ফলনে কৃষকের মুখেহাসি ফুটবে বলে মন্তব্য করেন- রাজশাহীর ঊর্ধ্বতন এ কৃষি কর্মকর্তা।
ব্রেকিংনিউজ/ এমএইচ