প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেছেন, বর্তমানে শিল্পের যে খাতগুলো প্রসারিত হচ্ছে, সেগুলোর সাপ্লাই চেইনের সাথে ছোট শিল্পের সংযোগ ঘটাতে হবে। এই সংযোগ স্থাপনটা অতীব জরুরি। আমাদের মেগাসিটি থাকলেও এখন বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সিএমএসমই খাতের উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
তিনি বলেন, নির্দিষ্টভাবে খুলনা অঞ্চলের সমস্যার সাথে বন্দরের সংখ্যার একটা ব্যাপার আছে, কেননা বর্তমান বাস্তবতায় দেশের অর্থনীতির জন্য একটা বন্দরের উপর বেশি চাপ পড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে এই সমস্যা কেটে যাবে বলে তিনি সবাইকে আশ্বস্ত করেন।
খুলনা অঞ্চলের সম্ভাবনায় মাছ চাষের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইস্যুতে এখানে সমস্যার তৈরি হয়েছে। মান পরীক্ষায় সার্টিফাইড হওয়ার জন্য এই অঞ্চলের পণ্য ঢাকায় আনতে হয়, তারপর আবার ফ্যাক্টরিতে নেয়া হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলেও সার্টিফাইড হওয়ার একই সমস্যা আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মশিউর রহমান বলেন, এসব সমস্যা সমাধানের জন্য ঢাকা কেন্দ্র থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে সব অঞ্চলে পৌঁছাতে হবে। সুযোগ এবং সম্ভাবনা পরিপূর্ণ রুপে ব্যবহার করতে উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো সেন্টার তৈরি করতে হলে ঢাকার পাশাপাশি পিছিয়ে পরা ঐ অঞ্চলগুলোতে পৌঁছাতে হবে অন্যথায় সংবিধানের সুষম আঞ্চলিক উন্নয়ন অর্জন সম্ভব হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনোভেশন, ক্রিয়েটিভিটি এন্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশীপ (আইসিই) সেন্টার এবং ইউএনডিপি বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে গৃহীত ‘রিভাইভ’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে সোমবার (১৮ জানুয়ারি) ভার্চুয়াল মাধ্যম জুমে ‘বাংলাদেশে সিএমএসএমইস: জার্নি, চ্যালেঞ্জেস এন্ড ফিউচার ডিরেকশন’ শীর্ষক খুলনা বিভাগীয় ওয়েবিনার এর আয়োজন করা হয়।
রিভাইভ প্রকল্পের অধীনে আটটি বিভাগীয় ওয়েবিনারের শেষ দিনে এই আয়োজনে আইসিই সেন্টারের ভাইস-চেয়ারম্যান ড খন্দকার বজলুল হকের সভাপতিত্বে এবং নির্বাহী পরিচালক জনাব মো. রাশেদুর রহমানের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড মশিউর রহমান এবং মূল বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনরারি অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ।
এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম, চ্যানেল আই এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও সংবাদ প্রধান এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি মো শাইখ সিরাজ। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউএনডিপি বাংলাদেশের সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি জনাব মো. খুরশিদ আলম, খুলনা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মো. কাজী আমিনুল হক এবং খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী অফিসার জনাব পলাশ কান্তি বালা।
অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনীতির অন্যতম একটি হাব হিসেবে খুলনা বিভাগ তার সম্ভাবনার দ্বারকে প্রসারিত করে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারী শিল্পের জাতীয় পর্যায়ের একটি সমৃদ্ধ ডেটাবেজের প্রয়োজনীয়তায় এই খাতের উন্নয়নের মাধ্যমেই আর্থ-সামাজিক সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।
উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের উদ্যোক্তা উন্নয়নের পরিবেশের ভিন্নতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই খাতের জন্য আমাদের খাত ভিত্তিক নীতি প্রণয়নের দিকে নজর দিতে হবে। একই সাথে তিনি এসএমই আইনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
রিভাইভ প্রকল্পের কার্যাবলী তুলে ধরে মো. রাশেদুর রহমান বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের সিএমএসএমই খাতের বিভাগ ভিত্তিক যে সমস্যাগুলো উঠে এসেছে সেগুলোকে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বিবেচনায় নিলে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারী শিল্পখাত দেশের অর্থনীতির চাকার গতিশীলতা বৃদ্ধিতে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে।
শাইখ সিরাজ বলেন, এসএমই উদ্যোক্তার সংজ্ঞা আমাদের পরিষ্কার করা উচিত। শহরের একজন তরুণের পাশাপাশি গ্রাম কিংবা মফস্বলের তরুণদের কিভাবে এই খাতে বিবেচনা করা হচ্ছে সেটি স্পষ্ট নয়। যে কৃষক মধু সংগ্রহ করেন, তিনি উদ্যোক্তা না হয়ে সেই মধু প্যাকেজিং করে বাজারজাতকরণকারী যেনো শুধু উদ্যোক্তার সংজ্ঞায় না আসে সেই বিষয়ে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
খুলনা বিভাগের পণ্যের ব্রান্ডিংয়ের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, সুন্দরবনের মধু, সম্ভাবনাময় গোলপাতার গুড়, চিংড়ি, কেচো সারসহ অর্গানিক সার, কোকোকিটের বিশাল বাজার নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে তাহলেই বাঙালি ঐতিহ্যের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে প্রসারিত করা সম্ভব হবে। অর্থনীতিতে ভ্যালু এড করা পণ্যের উতপাদকদের দিকে বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ইন্ডাস্ট্রির সাথে একাডেমিয়ার একটি শক্তিশালী সমন্বয় প্রয়োজন যেটির একটি নমুনা আইসিই সেন্টারের রিভাইভ প্রকল্প উদ্যোগের মধ্যে আরো স্পষ্ট হয়েছে। করোনা সংকট সিএমএসএমই খাতকে নিয়ে ভাবার একটি সুযোগ আমাদের তৈরি করে দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ভাবনার গভীরতার ধারাবাহিকতা রক্ষার কাজটা এখন আমাদের চালিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন দেশের মুক্তি সংগ্রামে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে, ঠিক তেমনি বর্তমান বাস্তবতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রে আবারও নেতৃত্ব দিতে হবে।
মো. খুরশিদ আলম বলেন, সংকট মাঝে মাঝে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। ৩৫ শতাংশ মানুষ এই খাতের সাথে সম্পৃক্ত। এর উন্নয়নে আমাদের ভবিষ্যত বিজনেস লিডার যা লাগবে। যার একটা নমুনা এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেখা গিয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে এম্প্যাথির জায়গাটাকে এক্সপ্লোর করতে সক্ষম হয়েছে।
জাপানের টয়োটা কোম্পানী ছোট ছোট ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে বড় এবং ছোট ব্যবসার লিংকেজে এখনো একটা বিস্তর ফারাক রয়েছে যেই চ্যালেঞ্জটি এড্রেস করা এখন সময়ের দাবি বলে তিনি মত দেন।
সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজকে সাধুবাদ জানিয়ে খুরশিদ আলম বলেন, ঘোষণার পর ডেলিভারির ক্ষেত্রে আমাদের সিএমএসএমই ব্যবসায়ীরা এখন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রান্তিক যে মানুষগুলোর কাছে একটা স্মার্টফোনের এক্সেসও নেই, তাদের কাছে কিভাবে আমরা সুবিধা পৌঁছাবো সেই বিষয়টি এড্রেস করার জন্য এখন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আমাদের নজর দিতে হবে।
সর্বশেষে প্রোগ্রামের সভাপতি ড. খন্দকার বজলুল হক বলেন, আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার জন্য প্রতিটি অঞ্চলের সম্ভাবনার সুযোগকে এখনি গ্রহণ করতে হবে।
অঞ্চলভিত্তিক সুযোগ তৈরি হওয়ার পরে সেই সুযোগ নেয়ার মানসিকতা থেকে আমাদের সকলকে বের হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিএমএসএমই খাতের উন্নয়নে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।
ব্রেকিংনিউজ/বিবি/নিহে