ব্যর্থতার ছাই থেকে সাফল্যের প্রাসাদ গড়ে উঠার উদাহরণ আছে অসংখ্য। নতুন চিন্তা, দক্ষতা, মেধা আর উদ্যমই ব্যক্তিকে পৌঁছে দেয় সাফল্যের চূড়ান্ত পর্বে। তেমনিভাবে জীবনকে তিল তিল করে গড়ে তুলতে পেরেছেন এ প্রজন্মের তারকা মির্জা তাওসীফ শরীফ।
সবসময় নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করা এই তরুণ নিজের প্রতিভাকে আড়াল করতে পারেননি। যেখানেই হাত দিয়েছেন পেয়েছেন সফলতা। লেখাপড়া, সংস্কৃতিচর্চা, খেলাধুলা থেকে শুরু করে গণিত প্রতিযোগিতা সবখানেই তার সফল পদচারণা। পরিবার-পরিজনের কাছে তিনি স্নিগ্ধ নামেই পরিচিত। নিজের ব্যক্তিত্বকে সবার মাঝে থেকে একটু অন্যভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ময়মনসিংহে বেড়ে ওঠা এ তরুণ। বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছেন। শখের বসেই বাবার হাত ধরে গণিতের দুনিয়ায় তার পথচলা। কিন্তু কে জানতো সেই শখ তাকে নিয়ে যাবে গণিত অলিম্পিয়াডের মতন বিশাল অঙ্গনে। ২০০৫ থেকে শুরু হয় তার এ গণিত অঙ্গনের যাত্রা।
চেষ্টা যে মানুষকে কতদূর নিতে যেতে পারে তারই দুর্দান্ত উদাহরণ হয়তো হতে পারেন স্নিগ্ধ। গল্পে গল্পে আর কিছুক্ষণের আড্ডায় তার স্বপ্ন আর সফলতার কথাগুলো নিয়েই সাক্ষাতকার সাজিয়েছেন ব্রেকিংনিউজের স্টাক করেসপন্ডেন্ট আহসান সবুজ।
ব্রেকিংনিউজ : কেমন আছেন?
স্নিগ্ধ: আলহামদুলিল্লাহ, চলছে।
ব্রেকিংনিউজ : সব সফলতাই কি স্নিগ্ধর জন্য?
স্নিগ্ধ: নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারার নামই আমার জন্য সফলতা।
ব্রেকিংনিউজ : স্নিগ্ধর জীবনে গণিত অলিম্পিয়াডের যাত্রাটা কেমন ছিলো?
স্নিগ্ধ : বাবা গণিতের শিক্ষক। ছোটবেলায় যখন উনি অন্য শিক্ষার্থীদের পড়াতেন তখন খুব জ্বালাতাম। তাই বাবা ছোট ছোট গণিতের সমস্যা দিয়ে আমাকে এবং আমার ভাইকে বসিয়ে দিতেন। এভাবেই শুরু হয় গণিতের প্রতি ভালোবাসা। ২০০৫ সালে যখন প্রথম গণিত অলিম্পিয়াডের মতো যায়গায় যাওয়ার সৌভাগ্য হয় তখন হাজারো অপরিচিত মানুষের মধ্য থেকে সৌভাগ্যক্রমে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার গৌরব অর্জন করি। সেই থেকে সরু লাইনের মাঝে দৌড়ে গিয়ে স্টেইজে উঠে লাল ফিতার মেডেলটি গলায় ঝুলানোর আকাঙ্ক্ষা আরো তীব্র হতে থাকে। ২০০৫ সাল থেকে প্রাইমারি ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাফোল্যের এ যাত্রা। যার ধারাবাহিকতা বজায় থাকে ২০১০ সাল পর্যন্ত।
ব্রেকিংনিউজ : সংস্কৃতিপাড়ায় আপনার প্রতিভার ঝলক সম্পর্কে জানত চাই?
স্নিগ্ধ: ‘নতুন কুঁড়ি’র মধ্য দিয়ে সংস্কৃতিপাড়ায় পথচলা শুরু। এরপর শাপলা কুঁড়ি, পদ্ম কুঁড়ি, জাতীয় শিশু-কিশোর সহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় গান, আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা, দেশাত্ববোধক গান, গজল, কোরআন তিলাওয়াত, পল্লীগীতি সবকিছু করেছি। পেয়েছি সফলতার পুরস্কারও।
ব্রেকিংনিউজ : এতো সফলতার মধ্যেও আপনার আরেক সফলতা শিক্ষাক্ষেত্রে। বাদ যায়নি খেলাধুলাতেও। সেখানেও ক্যারম, টেবিল টেনিসের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সফলতা পেয়েছেন। খেলাধুলার যাত্রাটা সম্পর্কে পাঠকদের কিছু জানাবেন কি?
স্নিগ্ধ : ময়মনসিংহ শহরে বেড়ে উঠা। খেলাধুলায় আগ্রহী করার মতো তেমন কেউ ছিল না। ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্র হিসেবে সবার ধারণা থাকতো আমিও হয়তো একদম ফিটফাট হয়ে ক্লাস করবো। কিন্তু ক্লাসের টিফিন টাইম ছিল আমার অনুশীলনের সময়। ৩০ মিনিটের টিফিন পিরিয়ডে এক মিনিটও মিস করতাম না। সবার এক্সপেক্টেশন রক্ষা করাও একটু মুশকিল ছিলো। কেননা ৩০ মিনিট অনুশীলনের পর নিজেকে ফিটফাট রাখাটাও বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে যেতো। তবু চেষ্টা করেছি। আর এভাবেই হয়ে গেলো।
অনুশীলন আর অধ্যবসায়ের জন্যই আজ স্নিগ্ধর সাফল্যের ঝুঁড়িতে আছে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি গেমস। টেবিল টেনিস খেলে ২০১৪ সালে জাতীয় পর্যায়ে ব্রোঞ্জ মেডেল। এরপর টানা ২০১৫-২০১৮ পর্যন্ত সিলভার মেডেল অর্জনের রেকর্ড। সাফল্যের গল্পটা এখানেই শেষ নয়, টেবিল টেনিসের সঙ্গে দাবা, ক্যারমেও আছে তার সৌভাগ্যের মুকুট। জাতীয় পর্যায়ে ক্যারমে তিনি ২০১৫ তে অর্জন করেন ব্রোঞ্জ মেডেল। তারপর থেকে ২০১৬-২০১৮ পর্যন্ত গোল্ড মেডেলের অর্জন তো আছেই। এতসব সাফল্যের মাঝে একটি কথা না বললেই নয়, তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক মঞ্চও মাতিয়ে এসেছেন। ২০১৯ সালে (ইরানিয়ান জিয়োম্যট্রি অলিম্পিয়াড) ৫৩ টি দেশের মাঝে ব্রোঞ্জ মেডেল পেয়ে ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে নিজ ক্যাটাগরিতে ১২তম হিসেবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। স্কুলজীবন থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত প্রতিটি দিন ছিলো স্নিগ্ধর জন্য একেকটি চ্যালেঞ্জ।
ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন। ২০১০ সালে বর্ষসেরা ছাত্রের মেডেলটিও তার হাতছাড়া হয়নি। নটরডেম থেকে কলেজ জীবন শেষ করে বুয়েট (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে নেন স্নাতক ডিগ্রি। এমনকি আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নগুলোর মাঝে ‘বুয়েট ব্লু’ উপাধিটিও আছে তার অর্জনের তালিকায়।
ব্রেকিংনিউজ : আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য আপনার সফলতার মন্ত্রটা জানাবেন কি?
স্নিগ্ধ : এখন আমাদের প্রজন্মের সোস্যাল মিডিয়ার ওপর ঝোকটা কমিয়ে নিজের ওপর ফোকাস করাটা খুব জরুরি। ফেসবুকে সময় নষ্ট না করে নিজের ক্যারিয়ার এবং পড়াশোনায় মনোযোগী হতে হবে। তাহলেই সফলতা আসবে।
ব্রেকিংনিউজ : আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
স্নিগ্ধ : আমার তিন ভাই। এর মধ্যে আমি ও মুগ্ধ জমজ। আমার মতো আমার ভাইও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সফলতা দেখিয়েছে। এবার আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি মিডিয়াপাড়ায় কিছু একটা করবো। ভবিষ্যতে স্নিগ্ধ ও মুগ্ধ জুটি দেখতে পাবেন দর্শকরা। গানের জগতে দুই জমজ ভাইয়ের নতুন জুটির মাধ্যমে দর্শক-শ্রোতারা নতুনত্বের স্বাদ পাবেন বলে আশা করছি।
ব্রেকিংনিউজ : আপনি ভালো থাকুন। আপনার সফলতা অব্যাহত থাকুক। আপনাকে ধন্যবাদ।
স্নিগ্ধ: আপনাকে ও ব্রেকিংনিউজ পরিবারকেও ধন্যবাদ।
ব্রেকিংনিউজ/এএইচএস/এমআর